ডেস্ক নিউজ : বিদেশে অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থানে সরকার। পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর কোনো কারণে সম্পদ জব্দ করা সম্ভব না হলে পাচারের অর্থের ওপর জরিমানা হিসেবে কর আদায় করা হবে। দেশ থেকে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও পাচার করা অর্থ-সম্পদ উদ্ধারের বিষয়ে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এসব বিষয়সহ ৯ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নে বিদ্যমান আইন সংশোধনের চিন্তা-ভাবনা আছে। পাশাপাশি বেশি অর্থ পাচার হওয়া দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির করারও পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানের নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিনিধি। জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান যুগান্তরকে বলেন, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটিতে পাচার রোধ ও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনাসংক্রান্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুমোদন দেয়া হয়েছে। জাতীয় কমিটির পরবর্তী মিটিংয়ে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে। সেখানে প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি আরও বলেন, প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নে বিদ্যমান আইনি কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন হতে পারে। সেসব বিষয়ে জাতীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা করা হবে।
সূত্র জানায়, ১৫ অক্টোবর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে উল্লিখিত ওয়ার্কিং কমিটির ১৮তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় টাকা পাচার প্রতিরোধ ও পাচার করা সম্পদ উদ্ধারের কৌশল নির্ধারণে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন অনুমোদন দেয়া হয়। পরে প্রতিবেদনটি অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটিকে পাঠানো হবে। ওই কমিটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে তা বাস্তবায়নে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হবে। আবু হেনা মো. রাজী হাসানের নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ৮ পদ্ধতিতে বিদেশে টাকা পাচার হয়ে থাকে। আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং বা ভুয়া ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৮০ ভাগ অর্থ পাচার হয়। এছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ, জমি বিক্রয় বা শেয়ার মার্কেট থেকে অর্জিত আয় হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়। এর বাইরে কুরিয়ার, বিনিময় ভিত্তিক পাচার, ইলেকট্রনিক্স পেমেন্ট, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, প্রি-পেইড কার্ড এবং শিক্ষা, চিকিৎসা খাতে অনুমোদিত রেমিটেন্স স্কিমের আড়ালে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। তবে এর পরিমাণ একেবারেই সামান্য। অর্থ পাচার রোধ ও পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে দুটি পদ্ধতি অনুসরণের সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। প্রথমত, অ্যাসেট রিকভারি বা সম্পদ জব্দ। দ্বিতীয়ত, ট্যাক্স রিকভারি বা কর আদায়। সম্পদ জব্দের বিষয়ে কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচার করা সম্পদ যাতে গায়েব বা নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায় সেজন্য পাচারের তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো জব্দ করতে হবে। জব্দ করা সম্ভব না হলে লেনদেন বা সম্পদ স্থানান্তর বিলম্বিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিদেশে অবস্থিত অর্থ-সম্পত্তি জব্দ বা অবরুদ্ধ করতে আদালতের আদেশ খুবই কার্যকর। বিএফআইইউর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বা লেটার অব রোগেটরির (প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জরুরি বার্তা) মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা যেতে পারে। তবে সব দেশে তা কার্যকর নয়। দেশের ভিতরের আর্থিক সম্পত্তি জব্দ করতে আদালতের আদেশ পেতে বিলম্ব হলে বিএফআইইউর সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
কর আদায় পদ্ধতি : সম্পদ জব্দকে অধিকতর সময়সাপেক্ষ ও কঠিন আখ্যা দিয়ে পাচারকৃত অর্থের ওপর ট্যাক্স রিকভারি বা কর আদায়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর আদায় একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া এবং তুলনামূলক কম জটিল। এতে ফৌজদারি মামলার প্রয়োজন হয় না। দুই দেশের কর সংশ্লিষ্ট এজেন্সি পর্যায়ে সহযোগিতার মাধ্যমেই অধিকাংশ ট্যাক্স রিকভারি প্রক্রিয়ায় মামলা নিষ্পত্তি করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, সুইস ব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর এজেন্সি (আইআরএস) ২০০৯ সাল থেকে অফশোর ভলানটারি ডিসক্লোজার প্রোগ্রামের আওতায় ৪৫ হাজার করদাতার কাছ থেকে ৬৫০ কোটি ডলার ফাঁকিকৃত কর, জরিমানা ও সুদ আদায় করেছে। এ ধরনের করদাতাদের কাছ থেকে ফ্রান্স প্রায় ১২০ কোটি ইউরো, ইতালি ৫৭ কোটি ইউরো, যুক্তরাজ্য ১৫ কোটি ইউরো এবং স্পেন ২১ কোটি ইউরো কর ও জরিমানা আদায় করেছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে পাচারকৃত অর্থের ওপর কর আদায়ের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। নতুন বিধান অনুযায়ী, কোনো করদাতার দাখিলকৃত আয়কর বিবরণীতে আমদানি-রফতানি প্রদর্শন করলে গৃহীত বা পরিশোধিত অর্থের সঙ্গে প্রকৃত লেনদেনের পার্থক্য থাকলে ওই পার্থক্যের ওপর ৫০ শতাংশ কর আদায় করা হবে। একইভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিবরণীতে প্রদর্শিত ও প্রকৃত বিনিয়োগের পার্থক্য থাকলে পার্থক্যের ওপর ৫০ শতাংশ কর আদায় করা হবে। প্রতিবন্ধকতা : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করা হতে তা বাজেয়াপ্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার কোনো প্রচেষ্টা বা সক্ষমতার ঘাটতি থাকলে বা পদ্ধতিগত জটিলতার সৃষ্টি হলে পুরো উদ্ধার প্রক্রিয়াই বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া পাচারকারীরা সাধারণ সম্পদশালী ও প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। ফলে তারা প্রচুর অর্থ খরচ করে বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করেন বা অন্য কোনো পথ অবলম্বন করে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার প্রয়াস চালান। এতে অনেক সময় তদন্ত কাজে বা বিচারিক পর্যায়ে হতাশা চলে আসে।
এতে আরও বলা হয়, অর্থনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক কারণে পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অন্যান্য দেশ একে অপরকে সহযোগিতা করে এবং পারস্পরিক দর কাষাকষিও করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশের পক্ষে এটি সম্ভব হয় না আইনগত সহযোগিতা চুক্তি না থাকার কারণে। বিদেশে দূতাবাসগুলোতে সম্পদ পাচারের মামলা তদন্ত করার জন্য কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়নি। ফলে বিদেশেও এ ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়নি। নয় দফা সুপারিশ : প্রতিবেদনে পাচারকারীর সম্পদ জব্দ এবং পাচারের অর্থের ওপর কর আদায় ছাড়া বাকি সাত দফা সুপারিশ হল- পাচার করা সম্পদ উদ্ধারের ব্যাপারে করা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি ডাটাবেজ তৈরি করা; বিচারিক প্রক্রিয়ায় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেয়া; মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও সমস্যা সমাধানে আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে দুদক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, অ্যাটর্নি জেনারেল, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব, পররাষ্ট্র সচিবের সমন্বয়ে একটি তদারকি কমিটি গঠন করা; দেশ থেকে যেসব দেশে টাকা পাচার হয় ওইসব দেশের সঙ্গে আইনগত সহায়তার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা; আইনগত সহায়তা প্রাপ্তি সহজীকরণ ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি করা, আইনগত সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো; পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আবর আমিরাত, সিঙ্গাপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে আর্থিক ও কর সংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থার উপযুক্ত প্রতিনিধিদের ১-২ মাসের জন্য পদায়ন করা। এতে সাফল্য এলে দীর্ঘ মেয়াদে পদায়ন করা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্নীতি কমানো, রাজনৈতিক ও বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো করতে না পারলে দেশ থেকে অর্থ পাচার রোধ করা যাবে না। কারণ সাধারণ মানুষ টাকা পাচার করে না। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থই পাচার বেশি হয়। অর্থ পাচার বন্ধ করতে সবার আগে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, পাচারকৃত অর্থে বিদেশে কেনা সম্পদের তথ্য ইন্টারনেটে বসে সহজেই পাওয়া সম্ভব। এজন্য গোয়েন্দাগিরির দরকার নেই। আর বিদ্যমান আইন-কানুনের মাধ্যমেই বিচার সম্ভব। দু-চারজনকে সাজা দিতে পারলে পাচারকারীরা সাবধান হয়ে যাবে, তখন পাচার বহুলাংশে হ্রাস পাবে।